ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত ১টা। এমনিতেই গভীর রাত তার মাঝে করোনা পরিস্থিতি। সবকিছু মিলে সুনশান নিরবতা, চারিদিকে অন্ধকার। বুধবার (২২ এপ্রিল) এমনই সংকটময় এক পরিস্থিতিতে জয়পাড়া প্রানকেন্দ্রের এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে প্রসব বেদনা নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছেন এক নারী ও তার সাথে থাকা দুই স্বজনরা। রাস্তায় নেই কোন যানবাহন। দুই স্বজনের কাঁধে ভর করে এদিক সেদিক ছুটোছুটিতে চিকিৎসা না পেয়ে যখন ক্লান্ত হয়ে গভীর রাতে জয়পাড়া সড়কে বসে প্রসব বেদনায় ছটফট করছিলেন তখন সেখানে টহলরত পুলিশের গাড়িতে থাকা এএসআই তুহিন তাদের দূর্দশা দেখে এগিয়ে যান তাদের কাছে। তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টি জানান দোহার থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সাজ্জাদ হোসেন ও ওসি (তদন্ত) আরাফাত হোসেনকে। গভীর রাতে প্রসব বেদনায় রাস্তায় পড়ে ছটফট করতে থাকা নারীর কষ্টের বিষয়টি অনুধাবন করে এগিয়ে আসেন পুলিশ সদস্যরা। ওই নারীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে ওসি সাজ্জাদ হোসেন ফোন করেন উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মো. জসিম উদ্দিন কে। সাথে সাথে পুলিশের তত্ত্বাবধানে তাদের গাড়িতে করে ওই অন্তঃসত্ত্বা নারীকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা না থাকায় উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার পরামর্শক্রমে তাকে জয়পাড়া ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হয়।
ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত ২টা ২০ মিনিট। করোনার এই সংকটময় পরিস্থিতিতে গভীর রাতে জয়পাড়া ক্লিনিকেও গাইনী সার্জন না থাকায় অনেকটা হতাশ হয়ে পড়েন ওসি সাজ্জাদ হোসেন ও আরাফাত হোসেন। এসময় ওই ক্লিনিক থেকে শিউলি আক্তার নামে দোহার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এক গাইনী সার্জনের কথা পুলিশকে জানালে ওসি সাজ্জাদ নিজে ওই চিকিৎসকের সাথে কথা বলে পুলিশের গাড়ি পাঠিয়ে তাকে জয়পাড়া ক্লিনিকে নিয়ে আসেন।
ডা. শিউলি আক্তার ক্লিনিকে এসে রোগীর সার্বিক পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন এবং রোগীকে দুই ব্যাগ রক্ত দেয়ার কথা বলেন। এমন পরিস্থিতিতে ওসি সাজ্জাদ ও আরাফাত হোসেন ওই রাতেই থানায় থাকা সব পুলিশ সদস্যদের ডেকে রক্তের গ্রুপ জিজ্ঞাসা করেন। এর মধ্যে ওই নারীর সাথে এসআই মশিউর রহমান ও কনস্টেবল মোসলেম উদ্দিনের রক্তের গ্রুপ ‘বি পজেটিভ’ মিলে যাওয়ায় দ্রুত রক্তের ব্যবস্থা করে ফেলেন। এরই মধ্যে রোগীর অতিরিক্ত শ্বাসকষ্ট শুরু হওয়ায় তাকে ঢাকায় নেয়ার পরামর্শ দেন ডা. শিউলি আক্তার। ওই চিকিৎসকের পরামর্শের প্রেক্ষিতে রাতেই পুলিশ নিজ দায়িত্বে অ্যাম্বুলেন্স ঠিক করে তাকে ঢাকায় পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।
বৃহস্পতিবার সকাল থেকে ফোনে ওই নারীর চিকিৎসার বিষয়ে সার্বিক তদারকি করেন ওসি সাজ্জাদ হোসেন, আরাফাত হোসেন ও এএসআই তুহিন। দুপুর দ্ইুটার দিকে ওই নারীর গর্ভ থেকে এক কন্যা সন্তান পৃথিবীর আলোর মুখ দেখে। জানা যায়, মা ও মেয়ে দুজনই সুস্থ রয়েছেন।
দোহার থানার ওসি (তদন্ত) আরাফাত হোসেন বলেন, মানবিক দায়িত্ববোধ অন্যরকম একটি বিষয়। এটি প্রতিটি মানুষের মাঝেই জাগ্রত থাকা উচিত। সে হোক পুলিশ, ডাক্তার বা যে কোন পেশাজীবি। আমরা যে কাজটি করেছি আমাদের মানবিক দায়বদ্ধতা থেকে করেছি।
দোহার থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সাজ্জাদ হোসেন বলেন, গভীর রাতে যখন এএসআই তুহিন আমাকে বিষয়টি বলেন তখন আমার ভেতর থেকে মনে হয় আমার কোন স্বজন বা বোন হয়তো প্রসব বেদনায় রাস্তায় পড়ে ছটফট করছে। আমার মন থেকে ওই বোনের চিকিৎসার জন্য দায়িত্ব পালন করেছি একজন ভাই হিসেবে, একজন মানুষ হিসেবে। করোনা পরিস্থিতিতে আমাদের পরিবার-পরিজন ফেলে আমরা মাঠে কাজ করছি, জানিনা আমাদের ভবিষ্যত কি! আমরা সেটা ভেবেই মানবিক দায়িত্ববোধ থেকে দায়িত্ব পালন করেছি। ভাল লেগেছে আমাদের কষ্ট স্বার্থক হয়েছে, মা ও মেয়ে এখন সুস্থ আছেন। আল্লাহ ওদের ভাল রাখুক। আমরা যেন মানবিক পুলিশ সদস্য হয়েই মানুষের মাঝে বেঁচে থাকতে পারি।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.