আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও জাতীয় শহীদ দিবস উপলক্ষে ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে একুশের প্রথম প্রহরে দোহার উপজেলার জয়পাড়া সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে অবস্থিত শহীদ মিনারে ফুল দিতে আসেন প্রশাসন, আওয়ামী লীগ ও বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন এবং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন। এসময় শুরু থেকেই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি লক্ষ্য করা যায় আগে ফুল দেয়াকে কেন্দ্র করে। আর সে বিশৃঙ্খলতার ষোলকলা পূর্ণ হয় আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাকর্মীদের ফুল দেয়াকে কেন্দ্র করে।
রাত ১২:০১ মিনিটে প্রথমে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আলমগীর হোসেন ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আফরোজা আক্তারের নেতৃত্বে প্রশাসন এবং পরিষদের কর্মকর্তারা দোহার উপজেলা পরিষদ, উপজেলা প্রশাসনের পৃথক ব্যানারে এক সাড়িঁতে দাঁড়িয়ে ফুল দিয়ে ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানান। এরপর দোহার থানা প্রশাসন ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স পুস্পস্তবক অর্পণ করেন। এ পর্ব শেষেই ছাত্রলীগের বিভিন্ন ইউনিট পুস্পস্তবক অর্পণ করতে থাকেন। প্রথম প্রহরের শুরু থেকেই বেদির উপর ফুল হাতে ছবি তোলা নিয়ে শুরু হয় বিশৃঙ্খলতা। বিশৃঙ্খলতা ও ধাক্কাধাক্কির মধ্য দিয়ে একে একে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ ও দলটির বিভিন্ন সংগঠন ফুল দিয়ে বেদির উপর ফটোশেসন করতে থাকলে বেদির নিচে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষমান উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড ইউনিটের নেতারা রাগ করে চেঁচামেচি শুরু করেণ। একপর্যায়ে তাঁরা ফুল না দিয়ে চলে যেতে থাকলে উপজেলা চেয়ারম্যান আলমগীর হোসেন ও ওসি সাজ্জাদ হোসেন বারবার তাদের অনুরোধ করতে থাকেন ফুল দেয়ার জন্য। অনুরোধের প্রেক্ষিতে বাধ্য হয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধারা অন্তত ১২/১২টি সংগঠনের পরেই পুস্পস্তবক অর্পন করতে উঠলে বেদী দখল করে ছবি তোলার জন্য দাঁড়িয়ে থাকেন অনেক তরুন-যুবক। এমন পরিস্থিতিতে রাগারাগি করতে করতে চলে যান মুক্তিযোদ্ধারা। প্রকাশ্যেই নিন্দা জানান এমন বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির। মুক্তিযোদ্ধাদের ফুল দেয়ার পরপরই শুরু হয় ঠেলাঠেলি ও বিশৃঙ্খলতার আরেক পর্ব। বিভিন্ন এলাকার বিভিন্ন ক্ষুদে সংগঠন এবং আওয়ামী লীগের পাতি ও উঠতি নেতাদের ঠেলাঠেলিতে শ্রদ্ধা জানাতে পেছনে পরে যায় যুবলীগের মত বৃহৎ অঙ্গসংগঠনও। অনেকে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো. আলমগীর হোসেনের হাত দিয়ে পুস্পস্তবক অর্পণ করে তাঁর সাথে ছবি তোলার জন্য রীতিমতো একরকমের ধাক্কাধাক্কির যুদ্ধে নামতে দেখা যায়। জুতা পায়ে বেদিতে উঠার দৃশ্য তো ছিল একেবারে লক্ষ্যনীয়। একপর্যায়ে দোহারের ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকদের নিয়ে নব্য গড়ে উঠা সংগঠনের নেতারা মোতালেব খানের নেতৃত্বে গেঞ্জি গায়ে পুস্পস্তবক হাতে শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে এলে ভিড়ের তোড়ে দুইবার বাঁধার মুখে পড়েন। ঠেলাঠেলি করে ফুল হাতে বেদিতে উঠলেও ছবি তুলতে থাকা যুবলীগের নেতাকর্মীরা তাদের নামিয়ে দেন। এমন পরিস্থিতিতে কোনরকমে সংকুচিত হয়েই ভাষা শহীদদের পুস্পস্তবক অর্পণ করে চলে যায় সংগঠনটির সদস্যরা।
বিশৃঙ্খলতার এমন ধারাবাহিকতায় পুস্পস্তবক অর্পণ চলতে থাকলেও তার ষোলকলা পূর্ণ হয় আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাকর্মীদের ঘিরে। দীর্ঘক্ষণ পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহবুবুর রহমান দোহার উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নজরুল ইসলাম বাবুল ও সাধারণ সম্পাদক আলী আহসান খোকন সহ উপজেলার সিনিয়র আওয়ামী লীগ নেতারা পুস্পস্তবক অর্পণ করতে সামনে আসেন। তাদের দেখামাত্র বেদির সামনে থাকা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ‘ভেসে যাবে বন্যায়’ স্লোগাণ শুরু করেন। এমনসময় পেছন থেকে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলী আহসান খোকন সিকদার স্লোগাণ দিতে থাকা নেতাকর্মীদের ধমক দেন। বলেন, “২১শে ফেব্রুয়ারিতে কোন স্লোগাণ হবেনা”। স্লোগান থেমে গেলেও পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠে তখন। একরকম ধাক্কাধাক্কির মধ্য দিয়ে মাহবুবুর রহমানের নেতৃত্বে ঢাকা জেলা ও দোহার উপজেলা আওয়ামী লীগ পুস্পস্তবক হাতে বেদিতে উঠার সময় সামনে দিয়ে দৌড়াদৌড়িতে পুস্পস্তবক দুটি ভেঙে টুকুরো হয়ে যায়। রাগ করে মাহবুবুর রহমান পেছনে চলে যান। একপর্যায়ে তিনি বেদিতে উঠে শহীদদের শ্রদ্ধা জানান। পরিস্থিতি বিশৃঙ্খল দেখে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। মাহবুবুর রহমান ও আলী আহসান খোকন সহ সিনিয়র আওয়ামী লীগ নেতারা উচ্চস্বরে বলতে থাকেন, “উপজেলা আওয়ামী লীগ ফুল দেয়ার আগে কিভাবে সহযোগী সংগঠনগুলো ফুল দিল তা জানতে চাওয়া হবে।”
এ বিষয় নিয়ে রাগারাগি করতে করতে চলে যান তাঁরা। এরপরই ঢাকা জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগ, দোহার প্রেস ক্লাব সহ অপেক্ষমান আরও কয়েকটি সংগঠন পুস্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে দোহারে একুশের প্রথম প্রহরে ভাষা শহীদের শ্রদ্ধা জানান।
বিশৃঙ্খল এমন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দোহার থানার অফিসার ইনচার্জ ও তাঁর সহকর্মীদের সরব দেখা গেলেও শেষ পর্যন্ত কোন শৃঙ্খলা আনতে ব্যর্থ হন তাঁরা।
মুখের ভাষার জন্য প্রাণ দিয়ে বিরল ইতিহাস গড়েছে বাঙালি। এই আত্মত্যাগ বিশ্বসভায় পেয়েছে অনন্য মর্যাদা। সেই রক্তাক্ত স্মৃতিবিজড়িত অমর একুশে ফেব্রুয়ারির গর্বের শহীদ মিনারে প্রথম প্রহরে শ্রদ্ধা জানাতে আসা মুক্তিযোদ্ধা ও সুশীল সমাজের ব্যক্তিরা শ্রদ্ধা জানানোর এমন পরিস্থিতিকে অনাকাঙ্খিত এবং বিশৃঙ্খল বলে মনে করেন। তাদের দাবি, আগামী বছর থেকে এ ধরণের পরিস্থিতি এড়াতে প্রশাসন ও রাজনৈতিক সংগঠনের সমন্বিত ভূমিকা নিতে হবে আগে থেকেই।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.