ঘরে বয়স্ক বাবা-মা প্রতিমূহুর্তে ছেলের জন্য দুশ্চিন্তায়। তবুও থেমে নেই ছেলে ডা. হরগোবিন্দ সরকার অনুপ। করোনা সংকটের শুরু থেকে নিজেকে অগ্রভাগের একজন যোদ্ধা হিসেবে মেলে ধরেছেন সকল পিছুটানকে পেছনে ফেলে। সংকটের শুরু থেকেই দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার জনগণকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন নিরলসভাবে। নবাবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ও করোনা কন্ট্রোল কর্ণারের ফোকাল পার্সন হিসেবে কর্মরত আছেন ডা. অনুপ। প্রকৃত সেবার মনোভাব নিয়ে দিনরাত কাজ করে চলা এই চিকিৎসকে ঘিরে প্রশংসা চলছে এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও।
ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার বান্দুরা হলিক্রস উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক-শিক্ষিকা ও নয়নশ্রী ইউনিয়নের রাহুতহাটি গ্রামের বাসিন্দা হরিদাস সরকার (৬৬) ও প্রাণ তুলশী সরকার (৫৮) দম্পতির তিন ছেলে মেয়ের মধ্যে বড় হরগোবিন্দ সরকার অনুপ (৩৫)। বোন পুষ্প সরকার (৩২) মেজো। তিনি নবাবগঞ্জ সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের একজন সহকারী শিক্ষিকা। ছোট ভাই হরনাথ সরকার অর্ণব (২৬) এমবিবিএস, এফসিপিএস (মেডিসিন) পার্ট-১ এর একজন চিকিৎসক। সে সাভার এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন। ডা. অনুপের স্ত্রী শর্মিষ্ঠা দাস সরকার (২৮) পেশায় একজন চিকিৎসক। ঢাকার ধানমন্ডির গ্রীন লাইফ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন তিনি।
ডা. হরগোবিন্দ সরকার অনুপ বলেন, আমাদের পরিবারে আমি, আমার স্ত্রী ও আমার ছোট ভাই চিকিৎসক। আমরা পৃথক তিন হাসপাতালে কর্মরত আছি। করোনাভাইরাসের মহামারীতেও আমরা তিনজনই অবিরত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি। তাই আমাদের বয়স্ক বাবা-মা সারাক্ষণ আমাদের নিয়ে চিন্তিত থাকেন। কিন্তু তাতেও আমরা থেমে নেই। দেশ ও জনগনের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকেই কাজ করে যাচ্ছি।
চলমান পরিস্থিতিতে নিজের কাজের বর্ণনা দিয়ে ডা. অনুপ জানান, প্রচন্ড রোদে তীব্র গরমের দাবদাহ ও ঝড়-বৃষ্টি। এরমধ্যেই চলছে আমাদের করোনার সঙ্গে লড়াই। আমরা আছি চন্দ্র অভিযানের স্যুট (পিপিই) পড়ে। গরমে ঘামে কাপড় একদম ভিজে যায়। নিঃশ্বাসের বাষ্পে গগ্লস এর ভিতর চোখ ঝাপসা হয়ে যায়, মাস্কে দম আটকে আসে। তার মধ্যে প্রতিটি মুহূর্ত মা-বাবাসহ পরিবারের সবাই আমাকে নিয়ে থাকে দুশ্চিন্তায়। তবুও থেমে না থেকে কাজ করে যাই ঘন্টার পর ঘন্টা, দিনের পর দিন। ছুটে বেড়াচ্ছি নবাবগঞ্জের এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্তে, এক ইউনিয়ন থেকে আরেক ইউনিয়নে। স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও এ কাজ করে যাচ্ছি। শুধু চাকরি নয়, মানবিক কারণে কাজ করে যাচ্ছি। মাঝে মধ্যে ক্লান্তি আসলেও পিছু না হটে নিজেকে করোনাযুদ্ধের প্রহরী মনে করে আবার সামনে এগিয়ে যাই। মহান সৃষ্টিকর্তার দয়ায় এবং জনগণের আর্শীবাদ ও দোয়ায় যতদিন সুস্থ থাকব দেশ ও জনগণের জন্য আমার এ লড়াই অব্যাহত থাকবে।
ডা. অনুপ আরও জানান, উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মো. শহিদুল ইসলাম স্যারের নেতৃত্বে করোনা মোকাবেলায় নবাবগঞ্জের স্বাস্থ্য বিভাগ দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছে। করোনা মহামারীতে আমাদের হাসপাতালের সকলেই কম বেশি দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। চিকিৎসক, নার্স, স্যাকমো, স্বাস্থ্য ও স্যানিটারী পরিদর্শক, ল্যাব টেকনোলজিস্ট, স্বাস্থ্য সহকারী, সিএইচসিপি, ড্রাইভার সকলে মিলে টিম ওয়ার্ক কাজ করে যাচ্ছি। এছাড়াও প্রতিনিয়ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমার আইডি থেকে উপজেলায় প্রতিদিন করোনা পরিস্থিতির আপডেট, এ রোগ বিষয়ক তথ্য, পরামর্শ, চিকিৎসা করোনাভাইরাস মোকাবেলায় বিভিন্ন বিষয়ে উপজেলাবাসীকে সচেতন ও সর্তক করে বিভিন্ন স্ট্যাটাস দিয়ে যাচ্ছি। এছাড়াও ২৪ ঘন্টা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে করোনা বিষয়ক টেলিমেডিসিন সেবা দিয়ে যাচ্ছি। পাশাপাশি সংবাদকর্মীদেরও প্রতিনিয়ত তথ্য দিয়ে যাচ্ছি।
এ বিষয়ে ডা. অনুপের বাবা হরিদাস সরকার প্রিয়বাংলা নিউজ২৪ কে বলেন, ছেলেকে নিয়ে প্রতিনিয়ত দুশ্চিন্তায় থাকলেও দেশের এই সংকটে আমার ছেলে যে ভূমিকা রেখেছে, তাতে বাবা হিসেবে আমি গর্বিত।
মা প্রাণ তুলশী সরকার বলেন, ছেলের জন্য সবসময় চিন্তা হয়। তারপরও ভালো লাগে এই ভেবে যে, আমার সন্তানের জন্য দেশ ও জনগণ উপকৃত হচ্ছে।
নবাবগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা আসাদ, সুমাইয়া, উল্লাস, জুয়েল ও মাহফুজা বেগমসহ আরও বেশ কয়েকজন প্রত্যক্ষ ও টেলিমেডিসিন সেবাগ্রহণকারী জানান, হরগোবিন্দ সরকার অনুপ তিনি শুধু একজন ডাক্তার নন, তিনি মানবতার বন্ধু। দেশের এই ক্রান্তিকাল মহামারী করোনাভাইরাসের প্রার্দুভাবে তিনি যেভাবে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তা সত্যিই প্রশংসনীয়। জীবন বাজি রেখে দেশ ও জাতির কল্যাণে দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে তিনি যে মানবতার বন্ধু তার প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছেন। চষে বেড়াচ্ছেন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর খোঁজে নবাবগঞ্জের এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্তে। তাকে নিয়ে উপজেলাবাসী গর্ববোধ করেন। তিনি জাতির সম্পদ। মহান সৃষ্টিকর্তা যেন তাকে সুস্থতাসহ দীর্ঘ জীবন ও কল্যাণ দান করেন। ডা. অনুপকে নিয়ে এ ধরনের প্রশংসা এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক জুড়ে।
ডা. অনুপের শিক্ষা জীবনঃ এসএসসিঃ ২০০০ সালে বান্দুরা হলিক্রস হাই স্কুল থেকে ৫টি বিষয়ে লেটারসহ স্টার মার্ক। এইচএসসিঃ ২০০২ সালে ঢাকার নটরডেম কলেজ থেকে স্টার মার্ক। এমবিবিএসঃ ২০১০ সালে শহীদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ। সিসিডিঃ ২০১২ বারডেম (ডায়াবেটলজী), সি কার্ডঃ ২০১৩ (হৃদরোগ) ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন, ২০১৪ সালে ৩৩তম ঢাকা বিসিএস (স্বাস্থ্য) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। এছাড়াও ২০১১ ও ২০১৪ সালে মেডিসিন ও শিশু রোগে প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন তিনি।
কর্ম জীবনঃ প্রথমে ঢাকার উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালের ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার হিসেবে যোগদান। দ্বিতীয়ত শহীদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রভাষক, তৃতীয়ত উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার, চতুর্থত ২০১৪ সালে সরকারি চাকুরী ৩৩তম বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারে যোগদান করেন।
সরকারি চাকরি: প্রথম পোস্টিং হয় মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। দ্বিতীয় পোস্টিং ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। তৃতীয় পোস্টিং দোহার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। বর্তমানে নবাবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার (রোগ নিয়ন্ত্রণ), ফোকাল পারসন করোনা কন্ট্রোল কর্ণার, টীম লিডার করোনা নমুনা সংগ্রহ কার্যক্রম ও ২৪/৭ টেলিমেডিসিন সেবা দেওয়ার (সম্পূর্ণ বিনামূল্যে) দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়াও প্রথম দিকে তিনি নিয়মিত বহিঃবিভাগে রোগী দেখাসহ ঈদ রোস্টার ও প্রয়োজনমত জরুরী বিভাগে দায়িত্ব পালন করেছেন।
করোনা কন্ট্রোল কর্ণার কার্যক্রমঃ স্বাস্থ্যকর্মী ও সিএইচসিপিদের মাধ্যমে স্বাস্থ্য ও স্যানিটারী পরিদর্শকদের সহায়তায় প্রবাসীদের তালিকা তৈরী, হোম কোয়ারেন্টাইন তদারকি ও স্বাস্থ্য সেবা প্রদান, করোনা সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা, ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনায় সহায়তা প্রদান। প্রয়োজন হলে এ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত রোগীকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় হাসপাতালে পাঠিয়ে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা ও সুস্থ হলে পুণরায় এ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করে বাড়িতে পৌছে দেয়া।
সামাজিক ও পেশাজীবি কর্মকান্ডঃ ডা. অনুপ বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের আজীবন সদস্য, দোহার-নবাবগঞ্জ পেশাজীবি পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, দোহার-নবাবগঞ্জ সোশ্যাল মুভমেন্টের সহ-সভাপতি, স্বপ্ন সমাজ কল্যাণ সংস্থার সভাপতি, সেভ দি সোসাইটি এন্ড ঠান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেসের স্বাস্থ্য সম্পাদক ও নবাবগঞ্জ উপজেলা কল্যাণ সমিতির মডারেটর।
ব্যক্তিগত সামাজিক কার্যক্রমঃ তিনি অসংখ্য বিনামূল্যে স্বাস্থ্য ক্যাম্প পরিচালনা করাসহ বিনামূল্যে ঔষধ বিতরণ, বিনামূল্যে ডায়াবেটিস চেকআপ, করোনা মহামারীতে প্রায় অর্ধশতাধিক পরিবারকে খাদ্য সহায়তা প্রদানসহ বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তিকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছেন।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.