গত কয়েকদিন ধরে বাংলাদেশের সংসদ-সদস্যদের ধান কাটার বিষয়টি ভাইরাল হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে অনেকেই ঝাঁপিয়ে পড়েছেন কৃষকের ধান কেটে দিতে। ধান কাটতে গিয়ে কেউ কেউ আবার কাঁচা ধান কেটেছেন বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কৃষকের ধান কেটে দিয়ে যে প্রশংসা কুড়িয়েছিল তা ধুলোয় মিশিয়েছে আমাদের সম্মানিত সংসদ সদস্যগণ। তাদের কারো কারো ধান কাটার দৃশ্য দেখে মনে হয়েছে কোন শুটিং চলছে। ক্যামেরা আর সাংবাদিকের ভিড়ে ধান কাটাই যেন গৌন হয়ে ধরা দিয়েছে। আপাতদৃষ্টে মনে হয়েছে ধান কাটার চেয়ে ছবি তোলাতে এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে দেখাতেই তারা বেশি আগ্রহী। কৃষকের ধান কাটা এবং ধান কাটা শ্রমিকদের উৎসাহ দিতে নেতাকর্মীদের নিয়ে ধানকাটতে যাওয়া অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে এবং একাজে কৃষকের উপকারই হবে। কোন কোন সংসদ সদস্যকে আমি কৃষকের বেশে ধান কাটতে ও দেখেছি যার পিছনে ২০-২৫ টি ক্যামেরা ছিল না। এই কাজগুলি অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে।
এই প্রসঙ্গে জাপানের একটি অনিন্দ্যসুন্দর ধান কাটার উৎসব এর কথা পাঠক কে জানাতে চাই। জাপানের কানাজাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরেট পর্যায়ের গবেষণাকালে আমি একটি ধানকাটা উৎসবে যোগ দিয়েছিলাম। অসম্ভব জনপ্রিয় এই অনুষ্ঠানে গিয়ে আমি মুগ্ধ হয়েছি আর ভেবেছি আমাদের সরকার যদি এমন ধানকাটা উৎসবের আয়োজন করত তাহলে কৃষকের কত উপকার হতো। পাঠক চলুন জেনে নেই কি সেই জাপানিজ ধান কাটার উৎসব।
জাপানের শহর কর্তৃপক্ষ প্রতিবছর একসাথে ধান কাটা ও বিবাহ উৎসবের আয়োজন করে থাকে তাদের নিজ খরচে। এই উৎসবের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে কৃষকের ধান কেটে ঘরে তোলা। এই উৎসবে শহর কর্তৃপক্ষ ধান কাটার পাশাপাশি বিয়ের আয়োজন করে। আগে থেকেই নির্ধারণ করা থাকে কোন কোন দম্পতির বিয়ের আয়োজন ধানকাটা অনুষ্ঠানে হবে। এই বিয়ের খরচ বহন করে থাকে শহর কর্তৃপক্ষ। এই উৎসবের খবর বিভিন্ন মিডিয়াতে প্রচার করা হয়ে থাকে এবং আগে থেকেই রেজিস্ট্রেশন নেওয়া হয় কারা কারা এই ধানকাটার অনুষ্ঠানে যোগদান করবেন। তেমনি একটি অনুষ্ঠানে যোগদানের সৌভাগ্য হয়েছিল আমার।
রেজিস্ট্রেশন এর সংখ্যা অনুযায়ী নগর কর্তৃপক্ষ ধান কাটার জন্য কাঁচি, হ্যান্ড গ্লাভস এবং বুটের জোগাড় করে রাখে। মানুষজন যাওয়ার সাথে সাথেই তাদের হাতে ধরিয়ে দেয়া হয় এই তিনটি ধান কাটার উপকরণ। সবাই সারিবদ্ধ ভাবে নেমে পড়ে ধানক্ষেতে। ধান কাটা শেষ হলে যার যার ধান আঁটি বেঁধে জায়গা মত রেখে ফিরতে হয়।
বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করে নব দম্পতি লাইন দিয়ে ধান হাতে দাঁড়িয়ে থাকে, যারা ধান কেটেছে তাদের অভিনন্দন জানানোর জন্য। ধান কেটে ফিরে আসা মানুষজনের মধ্যে কারো কারো হাতে হাতে নতুন বউ ধান উপহার দেয়। জাপানের স্থানীয় সংস্কৃতি অনুযায়ী যে ব্যাক্তি নতুন বউয়ের হাত থেকে উপহার হিসেবে ধান পায় তাকে ভাগ্যবান হিসেবে ধরা হয় । এই অনুষ্ঠানে স্বল্প মাত্রায় খাদ্য ও পানীয় এর আয়োজন থাকে। অনিন্দ্য সুন্দর এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কৃষকের ধান উঠে যায় ঘরে।
কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের ধানকাটাকে কি আমরা জাপানের মত এমনই একটি উৎসবে রূপান্তর করতে পারিনা? যে উৎসবে নেতৃত্ব দিবেন আমাদের সম্মানিত সংসদ সদস্যগণ। এই উৎসবের মাধ্যমে গ্রামের অনেক ছেলে মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান হয়ে যাবে। স্মরণীয় হয়ে থাকবে বিয়ে, স্মরণীয় হয়ে থাকবে ধান কাটা আর কৃষকের ঘরে উঠে যাবে ধান। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় এমনই একটি উৎসবের অপেক্ষায় রইলাম।
লেখা ও ছবি:
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
সাভার, ঢাকা ।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.