১৯৭১ সাল। শুরু হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে দেশের টানে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন আহাম্মদ শিকদার। অস্ত্র হাতে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিয়ে দেশের মানচিত্র ও লাল সবুজের পতাকা প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ভূমিকা রাখেন তিনি। তবে স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি মুক্তিযোদ্ধা আহাম্মদ শিকদার। এখনো তার নাম তালিকাভুক্ত হয়নি মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় গেজেটে। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সরকারি সকল সুযোগ সুবিধা থেকেও বঞ্চিত মানিকগঞ্জের একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা।
সরকারি গেটেজভুক্ত হওয়া থেকে বঞ্চিত এই বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম আহাম্মদ আলী শিকদার। মানিকগঞ্জ জেলার হাটিপাড়া ইউনিয়নের বড় বরুন্ডী গ্রামের নছুরুদ্দিন শিকদারের ছেলে। ১৯৭১ সালে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার সময় ১৮ বছরের তরুন ছিলেন আহাম্মদ শিকদার। জীবনের মায়া ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেও এখন মেলেনি স্বীকৃতি।
তিন ছেলে, এক মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে আহাম্মদ শিকদারের সংসার। যুদ্ধ শেষে নেমে পড়েন জীবন যুদ্ধে। দেশ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করলেও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মেলেনি এই মুক্তিযোদ্ধার। জীবনসায়াহ্নে এসে স্বীকৃতি পেতে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের অনুগ্রহ প্রার্থনা করেছেন জাতির এই সূর্য সন্তান।
১৯৭১ সালে দেশ মাতৃকার টানে যুদ্ধ করেন তিনি। আর সহযোদ্ধা ছিলেন মানিকগঞ্জ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের জেলা ইউনিট কমান্ডের সহকারী কমান্ডার বীরমুক্তিযোদ্ধা মোসলেমউদ্দিন খান, বীরমুক্তিযোদ্ধা বিল্লাল শিকদার ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আব্দুর রাজ্জাক সহ আরো কয়েকজন। নবাবগঞ্জের মনিকান্দা থেকে যুদ্ধ চলাকালীন মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণও গ্রহণ করেন এই মুক্তিযোদ্ধা।
মুক্তিযুদ্ধের বর্ণনা দিতে গিয়ে আহাম্মদ শিকদার বলেন, ইকবাল হোসেনের খাঁনের নেতৃত্বে আমরা যুদ্ধে অংশগ্রহন করি। কয়েকবার আঘাতও পেয়েছি। একদিন শুনতে পেলাম মিলিটারিরা বরুন্ডি আক্রমণ করবে। রাত তখন সাড়ে ১২টা। তখন আমাকে বালিরটেক পাঠানো হলো স্পীড আনার জন্য। সেখান থেকে আসার পথে ২২ জন মিলিটারি সাথে একজন রাজাকার আমাকে দেখে ফেলে। আমি কোন মতে সেখান থেকে জীবন নিয়ে বাঁচতে পেরেছিলাম। কারন আমি একা ছিলাম তবে আমার কাছে ছিল একটি রাইফেল আর ১৭ রাউন্ড গুলি ছিল। আসার সময় পায়ে বেল কাটা ঢুকে যাওয়ার কয়েকদিন অসুস্থ ছিলাম। পরে দেশের জন্য জীবন বাজি রেখে আবারো যুদ্ধ করেছি। বরুন্ডি নদীর পাড়, এগারো সিরি এবং মানিকগঞ্জে তিনি যুদ্ধ করেছেন বলে জানান তিনি। মানিকগঞ্জ জেলার বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (মুজিব বাহিনী)’র কমান্ডার মফিজুল ইসলাম খান কামাল ও ডেপুটি কমান্ডার ইকবাল হোসেন খান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করায় তাকে স্বাধীনতা সংগ্রামের সনদপত্র দিয়েছিলেন বলে জানান এই মুক্তিযোদ্ধা।
তিনি আরো বলেন, বিএনপির আমলে ইন্টারভিউ দিলাম মানিকগঞ্জে। ইন্টারভিউতে বঙ্গবন্ধুর নাম বলায় আমারে ফেল করাইয়া দিলো। তারপর আসলো বঙ্গবন্ধুর কন্যা হাসিনার আমল। এখন আমাগো কমান্ডার বলতেছে আপনার নাম মনে ছিল না। একবার থানা কমান্ডারের কাছে শুনলাম একটা বিচিত্রা বইয়ে আমার নাম আসছে। বইয়ে দেখলাম ১৪০ জনের নাম আছে। হাটিপাড়া আর গড়পাড়া ইউনিয়নের। তখন মনে করলাম এইবার হয়তো স্বীকৃতি পামু। হায় সেটাও হলো না। আবারও ইন্টার ভিউ দিলাম পাসও করলাম। আবার ২০১৬ তে উপজেলায় ইন্টারভিউ দিলাম সে ইন্টার ভিউতে আমি এক নম্বর। তবুও আমি স্বীকৃতি পেলাম না। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বেশ কয়েকবার মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই ও নাম তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। সে সময় একই সনদধারী সহযোদ্ধাদের নাম গেজেট তালিকায় অর্ন্তভুক্ত করা হলেও প্রয়োজনীয় তদবিরের অভাবে ও অজ্ঞাত কারনে তার নাম তালিকাবদ্ধ করা হয়নি।
মানিকগঞ্জ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের জেলা ইউনিট কমান্ডের সহকারী কমান্ডার বীরমুক্তিযোদ্ধা মোসলেমউদ্দিন খান বলেন, আহাম্মদ আমাদের সাথে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। সে একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। বিভিন্ন কারনে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় ওর নাম নেই। যাতে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সে স্বীকৃতি পায় আমার পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে। তিনি আরো বলেন, আমাদেরও দুঃখ হয়। আমরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেলাম অথচ আমাদের সহযোদ্ধা স্বীকৃতি পেলেন না।
একই কথা বলেন তার সহযোদ্ধা স্থানীয় বাসিন্দা বীরমুক্তিযোদ্ধা বিল্লাল শিকদার ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আব্দুর রাজ্জাক। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে তারা বলেন, ১৯৭১ সালে আমরা এক সাথে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিলাম। দেশ স্বাধীন হয়েছে ৫০ বছর। আমরা দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসেবে স্বীকৃতি পেলাম, মাসে মাসে ভাতাও পাচ্ছি। অথচ এক সাথে যুদ্ধ করেও আহাম্মদ ও আরো কয়েকজন এখনো মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিটুকু পেল না। আহাম্মদ একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। তার স্বীকৃতি না পাওয়াটা দুঃখজনক। আশা করি সরকার আহাম্মদকে শেষ বয়সে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিয়ে সম্মান জানাবে।
স্থানীয় বাসিন্দা রফিকউদ্দিন মোল্লা (৮৫)বলেন, আমি নিজ চোখে দেখেছি আহাম্মদকে যুদ্ধ করতে। এলাকার সকলেই জানে আহাম্মদ মুক্তিযোদ্ধা। অথচ এখনো ও স্বীকৃতি পেল না। আমরা এলাকাবাসী চাই আহাম্মদ এবং ওর মতো প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা যারা এখনো স্বীকৃতি পাননি তাদের যেন দ্রুত স্বীকৃতি দেওয়া হয়। স্বাধীনতার ৫০ বছর অতিবাহিত হলো, অথচ অনেক মুক্তিযোদ্ধা এখনো স্বীকৃতি পাননি এটা জাতির জন্য দুঃখজনক।
আহাম্মদ শিকদারের নামে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সংশ্লিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের গেজেটভুক্ত না থাকায় তিনি স্বাধীনতা পরবর্তী দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সরকারি সকল সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছেন। স্ত্রী, তিন ছেলে ও মেয়ের সংসারে অভাব না থাকলেও দুঃখ রয়ে গেছে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি না পাওয়ার। তিনি ও পরিবারের সকলে এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী ও মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের সুদৃষ্টি কামনা করেন।
মানিকগঞ্জের হাটিপাড়া ইউনিয়নের বড় বরুন্ডী গ্রামের আহাম্মদ শিকদার জীবনের শেষ মুহূর্তে নজের নামটুকু মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় দেখে যেতে চান।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.