1. news@priyobanglanews24.com : PRIYOBANGLANEWS24 :
বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:৩৬ পূর্বাহ্ন

যে আক্ষেপ নিয়ে চলে গেলেন বাউল গানের ‘পরশমনি’ পরশ আলী দেওয়ান

শামীম আরমান
  • আপডেট : বুধবার, ১০ মার্চ, ২০২১
  • ১৫৭৬ বার দেখা হয়েছে

পরশ আলী দেওয়ান। ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতেন বড় হয়ে একজন বাউল শিল্পী হবেন। এজন্য নিজের এলাকা কিংবা পাশের এলাকায় কোন বাউল গান হলেই সেখানেই দর্শক হিসেবে ছুটে যেতেন। কে জানত যে, সেই ছোট্ট পরশই হয়ে উঠবে গ্রামগঞ্জের মানুষের প্রিয় বাউল শিল্পী। একদিন তার গান শোনার জন্য শহর ও গ্রামের বাউল গান পাগল মানুষ ছুটে বেড়াবেন। বাউল, বিচ্ছেদ, দেহতত্ত সহ জীবনমুখী অসংখ্য গানের ভান্ডার ছিলেন পরশ আলী দেওয়ান। স্বল্পসময়েই বরেণ্য বাউল শিল্পী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন দেশব্যাপী।

গুণী এই শিল্পী সোমবার (৮ মার্চ) দিবাগত রাত দুইটার দিকে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে মারা যান (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মঙ্গলবার সকালে তাঁর মৃতদেহ বাড়িতে নিয়ে আসা হলে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তার ভক্ত অনুসারীরা তাঁকে একনজর দেখতে ছুটে আসেন। ছুটে আসেন বাংলাদেশ বাউল শিল্পী সমিতির সদস্যরা। ওই দিনই বাদ আসর স্থানীয় সোনামিয়ার মাঠে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।

জানা যায়, পরশ আলী দেওয়ানের চাচা আদিল উদ্দিন ফকির ছিলেন একজন সাধক। তার ধ্যান-জ্ঞান সর্বদা সাধনায় মগ্ন থাকত। আদিল উদ্দিন ফকির প্রফেশনাল কোন শিল্পী ছিলেন না। কিন্তু তিনি তাঁর ভাতিজা পরশকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখতেন। ১০ বছর বয়স থেকে পরশকে পরম মমতায় গানের চর্চা করিয়েছেন। কিভাবে গানকে অন্তরে লালন করে গানের মধ্যে দিয়ে মানুষের ভালবাসা অর্জন করা যায় সেই ব্রত ছিল আদিল উদ্দিনের মনে। যখন পরশ আলীর ১৫ বছর বয়স তখন আদিল উদ্দিন তাকে কেরানীগঞ্জের কালীগঞ্জ এলাকার বাংলাদেশের প্রসিদ্ধ বাউল শিল্পী রজ্জব আলী দেওয়ানের সান্নিধ্যে পাঠান। কয়েকদিন কাটতেই ভাগ্যবিধাতার সুদৃষ্টি যেন পরশ আলী দেওয়ানকে জড়িয়ে ধরে। রজ্জব আলী দেওয়ানের কাছে তালিম নেওয়ার প্রথম বছরেই মাত্র ১৫ বছর বয়সে পরশ আলী দেওয়ান প্রথম পালাগানের জন্য ডাক পায় দোহারের পার্শ্ববর্তী উপজেলা নবাবগঞ্জের পাতিলঝাপ গ্রামে। সেখানে তাঁর প্রতিপক্ষ ছিল ইউসুফ আলী দেওয়ান। সে পালাগানে ইউসুফ আলী দেওয়ান প্রবীন তাই তাকে দেওয়া হয় গুরুর ভূমিকায় আর পরশ ছোট তাই তাকে দেওয়া হয় শিষ্যের ভূমিকায় পালাগান করার জন্য।

সেদিন ওই গ্রামের পাশাপাশি উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে মানুষ এসেছিলেন ইউসুফ আলী দেওয়ানের গান শোনার জন্য। সেই মঞ্চে গুরুর ভূমিকায় থাকা ইউসুফ আলী দেওয়ানকে কথার মারপ্যাঁচে আটকিয়ে ফাঁদে ফেলেছিলেন শিষ্য পরশ আলী। তখন ওই মঞ্চের দর্শকদের নিকট আবিষ্কৃত হয় নতুন এক কিশোর বাউল। সেদিনই মানুষ বুঝেছিল এই পরশ একদিন ‘পরশমনি’তে পরিনত হবে। আজ বাংলাদেশের যে কোন প্রান্তে পরশকে সবাই এক নামে চেনে বাউল শিল্পী হিসেবে। তার লেখা অনেক গান নিয়ে তৈরি হয়েছে তার একক এ্যালবাম। শুধু তাই নয়, দেশবরেণ্য ফোক স¤্রাজ্ঞী মমতাজ বেগম সহ অনেক গুণী বাউল শিল্পীর সাথে রয়েছে তার যৌথ গানের এ্যালবামও।

তার গাওয়া সব গানের মধ্যে সব চাইতে জনপ্রিয় গান ‘আমি তো মরে যাব, চলে যাব রেখে যাব সবই’। যদিও এই গানটি আরো অনেকে গেয়েছেন। তবে সব চাইতে পরশ আলী দেওয়ানের কন্ঠে এই গানটি বেশি জনপ্রিয়তা পায়। বাজারে পরশ আলী বয়াতীর উল্লেখযোগ্য এ্যালবামের মধ্যে রয়েছে, একক এ্যালবাম ভাঙ্গা নায়ে ধরছি পাড়ি, তত্ত্ব বিচ্ছেদ গান, মানবকূলে জন্ম দিয়ে (বিজয় বিচ্ছেদ), মমতাজের সাথে যৌথ এ্যালবাম শরিয়ত-মারফত, নারী-পুরুষ, পালাগান খাজা বড়পীর, হাশর কেয়ামত সহ আরো অসংখ্য গানের এ্যালবাম।

২০১৭ সালে পরশ আলী দেওয়ানের জীবনের একাল-সেকাল নিয়ে কথা হয় প্রিয়বাংলা’র প্রতিবেদকের সাথে। তখন তিনি বলেছিলেন ‘আমার ৬৯ বছর বয়সের মধ্যে ৫৯ বছর ধরেই আমি গানই করছি। আজকের পরশ আলী দেওয়ান আমি হতে পারতাম না, যদি আমার চাচা আদিল উদ্দিন ফকিরের অনুপ্রেরণা না পেতাম।’

পরশ বয়াতী এই প্রতিবেদককে কাছে বলেছিলেন, ‘জীবনের এতগুলো বছর গান করে কাটালাম কেউ আমার বাড়ির আঙ্গিনায় এসে এই অধমের গল্প শোনেনি কখনো। তাই আপনাকে পেয়ে কেন যেন অনেক কথা বলার সাধ জাগল বাউল মনে।’ মেলে ধরেছিলেন একাল-সেকালের কথা। এরপর তিনি তার স্মৃতিচারণ করে বলেছিলেন, ‘বেশ কয়েকবছর আগে আজকের ফোক স¤্রাজ্ঞী মমতাজ বেগম এমপি আমার বাড়িতে এসেছিল। তখন আমি দেশসেরা আর দশটি বয়াতির একজন ছিলাম। তখন মমতাজও খুব ভাল গায়। তখন তারও দেশে অনেক নাম, কেনইবা হবেনা। ছোটবেলা থেকেই মমতাজ তার বাবার কাছে গানের প্রথম তালিম নিয়েছিল। এভাবেই মমতাজ বেগমকে নিয়ে কিছু স্মৃতিচারণ করলেন পরশ আলী দেওয়ান। বলেছিলেন, মমতাজ একজন খুব ভাল মনের মানুষ। তার জন্য আমি আমার জীবনের বড় ধরনের এক বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছিলাম। যা আজও ভুলার নয়। সেদিন মমতাজ যদি আমাকে পরামর্শ না দিতেন তাহলে সেদিনের একটি ভুলে হয়ত পরশ আলী দেওয়ানের আজকের আলোময় সময়টা অন্ধকারে নিমজ্জিত হত। জীবনের এই দীর্ঘ সময়টার সাধ নিতে হয়তো পারতাম না। ভাল থাকুক মমতাজ, দোয়া রাখুক আমাদের জন্য যাতে আমরা বয়াতীরা ভাল থাকি সবসময়।’

পরশ আলী তখন আরো জানান, তার ওস্তাদ রজ্জব আলী দেওয়ানের নিকট তিনি ছাড়াও দেশের সেরা বাউল শিল্পীরা তালিম নিয়েছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য বয়াতী কালাম দেওয়ান, কুমিল্লার শহিদ দেওয়ান, মানিকগঞ্জের তারাব আলী দেওয়ান, টাঙ্গাইলের সুনীল সরকার, দোহারের আনোয়ার দেওয়ান, বিক্রমপুরের বুলু দেওয়ানসহ নাম না জানা আরো অনেকে ছিলেন রজ্জব আলী দেওয়ানের শিষ্য।

পরশ আলী দেওয়ান এই প্রতিবেদককে আক্ষেপের সাথে বলেছিলেন, শরীর না চললেও সংসারের খরচ চালাতে দুই একটি অনুষ্ঠান পেলে মনের জোরে ছুটে যেতেন তিনি। তিনি বলেছিলেন, ‘মানুষ মরে গেলে তাকে সম্মাননা দেওয়া হয়। কিন্তু বেঁচে থাকতে সম্মান দেখানো হয়না। তিনি আরও বলেছিলেন আমার ঘরে অসংখ্য সম্মাননা স্মারক ও একটি স্বর্ণের মেডেল আছে। তাতে তেমন আতœতৃপ্তি পাই না।’ মৃত্যুর পূর্বে সরকারিভাবে জাতীয় স্বীকৃতির দাবি ছিল এই দেশবরেণ্য গুণী এই বাউল শিল্পীর। কিন্তু তা আর হলনা। পরপারের ডাকে সাড়া দিয়ে হারিয়ে গেলেন না ফেরার দেশে।

বাউল শিল্পী মুন্সিগঞ্জের রাজ্জাক দেওয়ান ও মানিকগঞ্জের তরফ আলী দেওয়ান জানান, পরশ আলী ছিল তাদের আত্মার খোরাক। পরশ আলী দেওয়ান চলে যাওয়ায় এক বিশাল শূন্যতা সৃষ্টি হলো বাউল গানের জগতে।

পরশ আলী দোহার উপজেলার উত্তর জয়পাড়া মিয়াপাড়া গ্রামের মইজউদ্দিন ফকিরের একমাত্র ছেলে। এছাড়াও তাঁর দুই বোন ছিলেন। পরশ আলী বয়াতীর পাঁচ ছেলে, তিন মেয়ে ও দুই স্ত্রী আম্বিয়া বেগম ও বিজলীকে নিয়ে ছিল পরশ দেওয়ানের সংসার।

সোশ্যাল মিডিয়াতে শেয়ার করুন

Leave a Reply

এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ