মাসুম মিয়া। ঢাকা জেলার দোহার উপজেলার কাঠালীঘাটা গ্রামের সৎ, সাহসী এবং জনবান্ধব একজন মানুষের নাম। তবে একনামে তাঁর পরিচিতি মাসুম কন্ট্রাকটর হিসেবে। নামের আগে জুটেছে সম্মানজনক বীর মুক্তিযোদ্ধার খেতাবও। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে নিজের জীবনের মায়াকে পেছনে ফেলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। দেশপ্রেমে উদ্ধুদ্ধ হয়ে সহযোদ্ধাদের সাথে সম্মুখ সাঁড়িতে থেকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা পরীক্ষিত একজন সৈনিক। দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধে কখনো শত্রুর মোকাবেলায় পিছপা হননি মাসুম মিয়া। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ ক্ষেত্রের ধাপে ধাপে ছিল তাঁর অবদান। যে কারনে তাঁর স্মৃতিমাখা অবদানের কথা বেশ অকপটেই স্বীকার করেন তাঁর সহযোদ্ধা বীর মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম বাবুল, ফজলুল হক, ডা. বোরহান খান ও সোরহাব হোসেন।
দোহার উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম বাবুল বলেন, পালামগঞ্জের পোদ্দার বাড়িতে যে যুদ্ধ হয়েছিল তা ছিল দোহার থানার সবচেয়ে বড় যুদ্ধ। এই যুদ্ধে আমি, সোরহাব হোসেন, আলাউদ্দিন, মাসুম কন্টাকটার, ডা. বোরহান ও ডা. শম্ভু সরাসরি অংশগ্রহণ করেছি।
তাঁর আরেক সহযোদ্ধা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার ডা. বোরহান জানান, স্বাধীনতার প্রথম থেকে ১৬ই ডিসেম্বর মাসুম মিয়া যুদ্ধের ময়দানে ছিলেন। তিনি প্রকৃত একজন সাহসী মুক্তিযোদ্ধা।
ঢাকা জেলা আ’লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল হক বলেন, মাসুম কন্ট্রাকটারের মুক্তিযুদ্ধে যে অবদান সেটা কখনো অস্বীকার করা যাবে না। তিনি নিজের জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন।
জানা যায়, যুদ্ধ পরবর্তীতে যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্থদের সহযোগিতার জন্য গঠিত হয় ‘রেডক্রস’ সংগঠন। সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রথমে মাসুম মিয়াকে ঢাকার ধানমন্ডি এলাকায় দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ভাল কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে রেডক্রস-এর পক্ষ থেকে পুরো নোয়াখালী জেলার দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি সেখানে ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। সংগঠনের কার্যক্রম ১৯৭৫ সালের জুনে ক্লোজ হয়ে গেলে তিনি ঢাকা চলে আসেন। এরপর মিথ্যা অভিযোগে চার মাসেরও বেশি সময় জেল খাটতে হয়েছে মাসুম মিয়াকে।
সেই সময়ের স্মৃতিচারণ করে মাসুম মিয়া বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৯ বা ২০ তারিখ রাত ১টার দিকে আমার ভাইয়ের টিকাটুলির বাসায় হানা দেয় সাদা পোশাকের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। দরজা খুলতেই আমাকে, আমার চাচাতো ভাই চুনুœ ও শাহ আলম আশু’কে মারধর শুরু করে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী। এরপর আমাদের তিনজনকে গোপীবাগ রেললাইনের পাশে একটি আবর্জনার স্তূপের কাছে এনে পুরনায় বেধরক মারধর করে তারা। যারা ধরে এনেছিল তাদের মধ্যে একজন তখন আমাদের গুলি করে মেরে ফেলার নির্দেশ দেন। তবে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাই। পরের দিন আমাদেরকে যাত্রাবাড়ি থানায় আহত অবস্থায় হস্তান্তর করা হয়। তখন জানানো হয় আমাদেরকে গোপীবাগ মোড়ে বোমা হামলার ঘটনায় সন্দেহভাজন হিসেবে ধরা হয়েছে। ওইদিনই আমাদেরকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর স্পেশাল ব্রাঞ্চের মিন্টু রোডের অফিসে নেওয়া হলে তারা ১৫ দিনের সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠিয়ে দেন। কারাগারের জীবনগুলো ছিল অত্যন্ত কষ্টদায়ক। ১৫ দিন কারাগারে থাকার পর পুনরায় আমাদেরকে অনির্দিষ্টকালের জন্য সেখানে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। পরের বছর জানুয়ারির ৮ বা ৯ তারিখে হাইকোর্ট থেকে আমরা জামিন পাই।
এরপরই কর্মজীবনে প্রবেশ করেন মাসুম মিয়া। সুনামের সাথে করেছেন সরকারী বিভিন্ন কনষ্ট্রাকশনের বড় বড় প্রকল্পের কাজ। তিনি তাঁর মেধা ও অবারিত সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এলাকার মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির কথা চিন্তা করে পাড়ি জমান সুদূর জার্মানে। সেখানে ব্যবসা বানিজ্যের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে সুসংগঠিত করার ক্ষেত্রে তাঁর রয়েছে অনন্য অবদান।
প্রবাসে থাকলেও মাসুম মিয়ার চিন্তুা চেতনা ও মননে অবস্থান নিয়ে থাকে নিজ এলাকা ও এলাকার মানুষ। দুঃখ দুর্দশায়, দুর্ভোগে, দুর্যোগে কিংবা উন্নয়নে সব ক্ষেত্রেই অবদান রয়েছে তাঁর। মাসুম মিয়ার প্রতিষ্ঠিত কাঠালীঘাটা উচ্চ বিদ্যালয়টি এখন এলাকার শিক্ষার বাতিঘর হিসেবে জ্বলজ্বল করছে ঘরে ঘরে শিক্ষার আলো ছড়াতে। ১৯৫৩ সালের ৭ মে কাঠালীঘাটা গ্রামের কফিল উদ্দিন মিয়া ও মহিদুন্নেচ্ছা দম্পতির ঘরে জন্মগ্রহণ করেন মাসুম মিয়া। বর্তমানে মাসুম মিয়ার বয়স প্রায় সত্তরের কাছাকাছি। নিজের কর্মের মধ্য দিয়ে মানুষের ভালোবাসা নিয়ে জীবনের শেষ ধাপ পারি দিতে চান এই বীর মুক্তিযোদ্ধা।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.