তৈরি পোশাক খাতের নারী শ্রমিকরা ঘরের কাজে বেশি সময় দিয়েও নিজের যত্ন নিতে সময় পান কম। পুরুষ সহকর্মীর তুলনায় একজন নারী শ্রমিককে প্রতিদিন ঘরকন্যার কাজে ৩ ঘণ্টা বেশি সময় ব্যয় করতে হয়। এছাড়া পুরুষের তুলনায় নিজের যত্ন নিতে সময় পান কম তারা।
এতে নারী শ্রমিকের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যসেবায় ঘাটতি পড়ে। ঘরের কাজ ও কর্মস্থলের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে নারী শ্রমিকরা পড়েন বিপাকে। এ কারণে অনেক নারী শ্রমিক কারখানার কাজ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন। এ তথ্য জানা গেছে, শ্রমিকদের ওপর চালানো এক গবেষণায়।
রাজধানীর মিরপুরের চারটি তৈরি পোশাক কারখানার ১০০ জন নারী ও পুরুষ শ্রমিকের মধ্যে চালানো একটি র্যাপিড কেয়ার অ্যানালাইসিস জরিপে এই অবস্থা উঠে এসেছে।শনিবার ‘পোশাকশিল্পের নারী শ্রমিকের গৃহস্থালি ও যত্ন-সেবামূলক কাজের দায়িত্ব, প্রভাব ও করণীয়’ শীর্ষক একটি মতবিনিময় সভায় ওই জরিপের ফলাফল উপস্থাপন করা হয়। রাজধানীর মিরপুর-১১-এ বাংলাদেশ সেন্টার ফর কমিউনিকেশন প্রোগ্রাম (বিসিসিপি) ভবনে এর আয়োজন করে বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন (এনজিও) কর্মজীবী নারী।
দেশে গৃহকর্ম ও সেবামূলক কাজে নারী-পুরুষের মধ্যে ভারসাম্য নেই। একজন নারীর ভালো থাকা ও নিজের প্রতি যত্ন নেওয়ার ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এতে কর্মক্ষেত্রে নানা সমস্যার সম্মুখীন হওয়া অনেক নারী পোশাকশিল্প থেকে কাজ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন।
আয়োজকদের সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি দাতা সংস্থা অক্সফামের সহযোগিতায় ‘ট্রান্সফর্মিং কেয়ার ওয়ার্ক ফর ওমেন ইন রেডিমেড গার্মেন্টস সেক্টর’ শীর্ষক ওই জরিপ চালায় কর্মজীবী নারী।
কর্মজীবী নারীর সহসভাপতি শাহীন আক্তারের সভাপতিত্বে মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ছিলেন অক্সফামের হেড অব জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড সোশ্যাল ইনক্লুশন প্রোগ্রাম মেহজাবিন আহমেদ, প্রাইভেট সেক্টর পার্টনারশিপ ব্রোকার ফতেমা তুজ জোহরা।
জরিপের বরাত দিয়ে বক্তারা বলেন, গৃহকর্ম ও সেবামূলক কাজে নারী এবং পুরুষের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভারসাম্যহীনতা রয়েছে। এটা নারীর ভালো থাকা ও নিজের প্রতি যত্ন নেওয়ার ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ফলে কর্মক্ষেত্রে নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়ে পোশাকশিল্প থেকে অনেক নারী সরে আসতে বাধ্য হন।
সংগঠনের অতিরিক্ত নির্বাহী পরিচালক সানজিদা সুলতানার সঞ্চালনায় মতবিনিময় সভায় র্যাপিড কেয়ার অ্যানালাইসিসের ফলাফল উপস্থাপন করেন সংগঠনের প্রকল্প সমন্বয়ক রিনা আমেনা। জরিপে অবৈতনিক সেবামূলক কার্যক্রমের একটি চিত্র তুলে আনা হয়। এতে কর্মক্ষেত্রে তারা কী ধরনের বাধার সম্মুখীন হচ্ছে সে বিষয়গুলো শনাক্ত করা হয়েছে। এর ওপর ভিত্তি করে মতবিনিময় সভায় নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে তৈরি পোশাক শিল্পের নারী শ্রমিকের ক্রমহ্রাসমান পরিস্থিতি উন্নয়ন ও তাদের বাধা দূর করতে কারখানা ব্যবস্থাপক থেকে শুরু করে সমাজের প্রতিটি স্তরে আলোচনা করা হয়।
র্যাপিড কেয়ার অ্যানালাইসিসে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, তৈরি পোশাক খাতে কর্মরত নারী শ্রমিকরা প্রতিদিন প্রায় ৫ ঘণ্টা গৃহস্থালি ও যত্নমূলক কাজে ব্যয় করেন; যেখানে একজন পুরুষ শ্রমিক ব্যয় করে ২ ঘণ্টা। এ হিসেবে পুরুষের চেয়ে ৩ ঘণ্টা বেশি সময় ব্যয় করেন নারীরা।
অপরদিকে একজন পুরুষ নিজের জন্য প্রতিদিন গড়ে ১৩ ঘণ্টা সময় ব্যয় করেন, সেখানে একজন নারী সময় পান গড়ে ৯ ঘণ্টা। এক্ষেত্রে নারীরা প্রতিদিন পুরুষের তুলনায় ৩ ঘণ্টা কম সময় নিজের জন্য ব্যয় করেন। কর্মক্ষেত্রে অনেক বাধার সম্মুখীন হয়ে পোশাকশিল্প থেকে নারীকে সরে আসতে বাধ্য হন।
নারী শ্রমিক কাজল রেখা বলেন, ‘আমাদের সন্তানদের দেখাশোনা করাই চাকরি ছেড়ে দেওয়ার প্রধান কারণ। এছাড়া সন্তানকে নিরাপদে স্কুলে আনা-নেওয়া, দেখাশোনা করার কেউ থাকে না। এক্ষেত্রে যদি নারী শ্রমিকদের সহযোগিতা করা হয়, তাহলে তারা ঝরে পড়বে না।’
মিরপুর এলাকার একটি তৈরি পোশাক কারখানার কমপ্লাইন্স ব্যবস্থাপক বলেন, ডে-কেয়ার বিষয়ে শ্রম আইনে সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকতে হবে। কেবল বায়ারকে দেখানোর জন্য ডে-কেয়ার স্থাপন করলে হবে না বরং একজন শিশুকে সঠিকভাবে লালন-পলন করার জন্য সব সুযোগ-সুবিধা দানসহ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পরিচর্যাকারী নিয়োগ করে ডে-কেয়ার প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। এছাড়া কারখানার প্রতিনিধিরা পিতৃত্বকালীন ছুটি প্রয়োজন বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
প্রগতিশীল গার্মেন্ট শ্রমিক ফেডারেশন সাধারণ সম্পাদক কামরুন নাহার বলেন, ‘নারীদের মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রধান্য দেওয়া হয় না। তিনি ঘরে-বাইরে অনেক কাজের চাপে থাকেন। ফলে এক সময় ঘর সামলানো আর চাকরি সামলানোর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে না পেরে তারা কাজ ছেড়ে দেন।’
অক্সফামের হেড অব জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড সোশ্যাল ইনক্লুশন প্রোগ্রাম মেহজাবিন আহমেদ বলেন, ‘কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করার পর নারীর কাজের চাপ বেড়ে গেছে। নারী শ্রমিকের পক্ষে যে আইনগুলো আছে, সেগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন দরকার।’
সভায় বক্তারা বলেন, কারখানায় সরকারের নজরদারি আরো শক্তিশালী করতে হবে। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের ফ্যাক্টরিতে নিয়মিত পরিদর্শন প্রয়োজন। এছাড়া শ্রমিকের পুষ্টি চাহিদা পূরণের জন্য রেশন ও চাকরি শেষে পেনশনের ব্যবস্থা করতে হবে। তাছাড়া ৬ মাস মাতৃত্বকালীন ছুটিসহ ৬-১৮ বছর বয়সি শিশু-কিশোরদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তার দাবিও করেন শ্রমিক ও ট্রেড ইউনিয়ন নেতারা।
অনুষ্ঠানে কারখানার কর্মকর্তা, উন্নয়ন সংগঠন, আইএনজিও, অ্যাকাডেমিশিয়ান, নারী সংগঠন, শ্রমিক সংগঠনের নেতাসহ বিভিন্ন খাতে নিয়োজিত নারী ও পুরুষ শ্রমিক উপস্থিত ছিলেন।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.