“কষ্টগুলো প্রকাশ করতে মানা আর জীবনের কোনো ক্লান্তিলগ্নে খুব কান্না এলে তাতেও যেন মানা। কাঁদলেও কাঁদতে হবে নিরবে নিভৃতে।” এককথায় মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে জন্মগ্রহণ করা মানুষের জীবনের গল্প ঠিক এমনই।
করোনা ভাইরাসের সংক্রমন রোধে গত কয়েকদিন ধরেই ওষুধ ও নিত্যপন্য ছাড়া বন্ধ করে দেয়া হয়েছে সব ধরনের দোকানপাট। সে সাথে অনেকটা বন্ধ নিম্নবিত্ত পরিবারের আয়ের রাস্তা। রিক্সা বা ইজিবাইক নিয়ে রাস্তায় বেরোলেও নেই যাত্রী। আর যারা যাত্রী হিসেবে রিক্সা বা ইজিবাইকে যাবেন সেই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের পকেটেও নেই ভাড়ার টাকা। এই সময়ে হেঁটে হেঁটে নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজ শেষ করতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা। এ যেন কোনমতে সংসারকে বাঁচিয়ে রাখার আরেক সংগ্রাম। মানুষের মধ্যে যেন নিরব হাহাকার। সবাই নিরবে এই দুরাবস্থায় ভুক্তভোগী হয়ে দিন পার করছেন।
সোমবার রাতে কথা হয় দোহারের এক বস্ত্র ব্যবসায়ীর সাথে। প্রশাসনের নির্দেশ মেনে জয়পাড়া বাজারে ভাড়া নেয়া দোকানটি বন্ধ গত ছয়দিন ধরে। ঘর থেকেও বের হতে মানা। তারপরও সোমবার সন্ধার দিকে বাধ্য হয়ে বাজারে এসেছেন সন্তানের কেক খাবার দাবি পূরণ করতে। আলাপচারিতার ফাঁকে আক্ষেপ করে ওই ব্যবসায়ী বলেন, সঞ্চয় করা সব টাকা এই দোকানে বিনিয়োগ করেছি। অন্তত তিন লাখ টাকা দেনাও রয়েছি। সারাদিন যা হয় তা দিয়েই সংসার চালাই। বাড়িতে বাবা ছাড়াও স্ত্রী ও তিন সন্তান রয়েছে। প্রতিদিন বাবার জন্য ওষুধ প্রয়োজন হয়। তারপর ছোট মেয়েটার নানা বায়না তো রয়েছেই। প্রতিদিনের আয়েই কোনমতে এগুলো ম্যানেজ করি। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে যেভাবে চলছে তা বুঝাতে পারব না। না বলতে পারি স্ত্রীকে কিছু, না বলেতে পারি বাবাকে আর না বুঝাতে পারি ছয় বছরের ছোট্ট মেয়টাকে। এরই মধ্যে দুই বন্ধুর কাছ থেকে টাকা ধার করেছি। আজ বিকলে আবার ২ হাজার টাকা ধার করলাম। বাজারে এসেছি মেয়ে কেক খাবে, বাবার ওষুধ নিতে হবে সাথে নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু বাজার। ধার করা টাকা দিয়ে আজকের চাহিদা মিটিয়ে কোনমতে কাল সকালের মাছ-তরকারির চাহিদা পূরণ করতে পারব কিন্তু কাল বিকেলে কি করব জানিনা!
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, “আমার বাড়ির পাশে এক রিক্সাচালক আছে। ওই পরিববারটি এই অবস্থায় আমার থেকে ভাল আছে। সকালে দেখলাম রিক্সাওয়ালার বউ কোথা থেকে যেন সাহায্য পাওয়া চাল, ডাল তেল লবন নিয়ে এলো। আবার ছেলেটি রিক্সা নিয়ে বের হয়ে গেল। সারাদিন যাইকিছু হোক কামাই করে ফিরবে। আবার বিভিন্ন যায়গা থেকে ত্রাণ সাহায্যও আসছে। কিন্তু আমাদের মতো মানুষ কারও কাছে বলতে পারবে না, আমাদের এভাবেই চলতে হবে, কান্না এলে নিরবে কাঁদতে হবে।”
বর্তমান পরিস্থিতিতে সত্যিকার অর্থে মধ্যবিত্ত ও নি¤œমধ্যবিত্ত পরিবারের চিত্রগুলো ঠিক এমনই। যারা সরকারি বা বেসরকারি মাসিক বেতনে চাকরি করছেন তাঁরা হয়তো একটু ভাল থাকবেন। কিন্তু প্রতিদিনের আয়ে সংসার চালানো মানুষগুলোর অবস্থা করুন পরিস্থতির দিকে যাচ্ছে ক্রমেই। নিম্নবিত্ত পরিবারগুলো বিভিন্ন দিক থেকে পাওয়া ত্রাণ সাহায্যের জন্য লাইনে দাঁড়াতে পারলেও পারবেনা মধ্যবিত্ত ও নি¤œমধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষগুলো। তবুও এ জীবন যুদ্ধে জিততে হবে তাদের।
দোহার থেকে নবাবগঞ্জ কলেজে গিয়ে অনার্সে পড়াশোনা করেন সাদ্দাম (ছদ্দনাম) নামের এক তরুন। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। জীবনের প্রয়োজনে দোহারের একটি মোবাইলের দোকানে চাকরি করেন পার্টটাইম। ৭ হাজার টাকা বেতন পান। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে ওই দোকানটি বন্ধ থাকায় মালিক তাকে বন্ধ থাকা দিনগুলোতে বেতন দেবেননা বলে জানিয়ে দিয়েছেন। সাদ্দাম তাঁর বেতনের টাকা নেন সপ্তাহ ধরে। এ টাকা দিয়ে মায়ের ওষুধ সহ প্রয়োজনীয় চাহিদা ও ভাতিজির জন্য টুকটাক কিছু নিয়ে বাড়িতে ফেরন। বাকি টাকা ব্যায় করেন তার পড়াশোনার কাজে। এ সপ্তাহে টাকা দেননি মালিক। তবুও চলছে সাদ্দামের জীবন। এ ছেলেটি আজ সকালে এই প্রতিবেদকের ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে বর্তমান পরিস্থিতিতে মধ্যবিত্ত পরিবার সম্পর্কে তাঁর চিন্তাধারা নিয়ে একটি লেখা পাঠিয়েছেন। তা হুবহু তুলে ধরা হলো।
“আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবার। শুধু আর্থিকভাবে নয়, এই পরিবারের স্বপ্ন-চিন্তাচেতনা সবই আটকে যায় সেই জীবন নামক বৃত্তের মধ্যে। বৃত্তের চাপ অতিক্রম করে আমাদের যেতে মানা। আবার বৃত্তের মধ্যে টইটই করে ঘুরতেও মানা। মধ্যবিত্ত সন্তানগুলো সব চেয়ে বেশি তাদের মা-বাবাকে উপলব্ধি করতে পারে। নিজের সাধের সঙ্গে মা-বাবার সাধ্য কতটুকু সেটা ওরাই ভালো বুঝতে পারে। না পারলেও চেষ্টা করে। এক অদ্ভুত শিকলে বদ্ধ থাকে এই পরিবারগুলোর প্রতিটি জীবন। এখানে জীবন মানে চলতে হবে, থেমে গেলেই অচল গাড়ি! আমাদের চাওয়া-পাওয়াগুলোও সেই জীবনের গতির সঙ্গে নিয়ন্ত্রিত হয়। এই জীবনে সুখ থাকবে, থাকবে দুঃখ। তবে কষ্টগুলো প্রকাশ করতে মানা, জীবনের কোনো ক্লান্তিলগ্নে খুব কান্না এলে তাতেও মানা।”
বর্তমান পরিস্থিতিতে কথা হচ্ছে, এসব পরিবার কাল কি খাবে, মাস শেষে বাসাভাড়া দেবে কি করে, ছেলেমেয়ের লেখাপড়া কি চালিয়ে যাবে, না বন্ধ করে দেবে, এসব নিয়ে ব্যাপক চিন্তা ভাবনা চলছে। একই সাথে বিরাজ করছে হাহাকার ও চরম হতাশা। তিনবেলা খাবার যোগার করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। চোখে মুখে অন্ধকার দেখছেন পরিবারের প্রধান ব্যক্তি। কারণ আয় বন্ধ হলেও ঘুরছে সংসারের নিত্য চাকা। মুদি দোকানে বাকি বাকি পড়ে থাকছে। দিনগুলো কেটে যাচ্ছে ঠিকই-কিন্তু তা যন্ত্রণাময় বলে মনে করেন বোদ্ধামহল। উপার্জনহীনতার খড়গ ঝুলছে প্রতিটি মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর কাধে। আবার গুটিকয়েক পরিবারে সঞ্চিত টাকা থাকলে তা ভেঙ্গে খাচ্ছে এখন।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.