শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পরাধীন ছিল বাঙালি জাতি। অবহেলিত ও নিষ্পেষিত এই জাতিকে তিনি স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের। নিরলস পরিশ্রম, অপরিসীম ভালোবাসা আর আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে তিনি সারা দেশ ঘুরে ঘুরে জাতিকে জাগিয়েছিলেন। বাঙালির হাজার বছরের স্বাধীনতার স্বপ্নকে যিনি বাস্তবায়িত করেছিলেন, তিনি মহাকালের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনিই সবুজ-শ্যামলে ঘেরা পলিমাটিতে ‘বাংলাদেশ’ নামের স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের পত্তন করেছিলেন। উপহার দিয়েছিলেন লাল-সবুজের পতাকা, বিশ্বের বুকে অনির্বাণ এক মানচিত্র। আজ ১৭ মার্চ। বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠতম অর্জন, বাংলাদেশের রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মবার্ষিকী। ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’ নির্বাচিত এই মহান নেতাকে আজ গোটা জাতি স্মরণ করবে শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় আর অকালে হারানো জাতির পিতার জন্য বাঙালি জাতির হৃদয়-মনে অনুরণিত হবে কবি সুকান্তের সেই আকুতি ‘হে মহামানব, একবার এসো ফিরে/শুধু একবার চোখ মেলো এই গ্রাম নগরের ভীড়ে…’।
একজন মহান নেতা তাঁর দেশের মানুষকে কিভাবে ঐক্যবদ্ধ করতে পারেন, অপরিসীম সাহসিকতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন, সঠিক ও দূরদর্শী নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিঁড়ে ছিনিয়ে আনতে পারেন স্বাধীনতার উজ্জ্বল উদাহরণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
সাহিত্যিক ও ছড়াকার অন্নদাশঙ্কর রায় বঙ্গবন্ধুর কীর্তিকে স্মরণ করে ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর লিখেছিলেন কালজয়ী পঙক্তি, ‘যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান/ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান/দিকে দিকে আজ অশ্রুমালা রক্তগঙ্গা বহমান/তবু নাই ভয় হবে হবে জয়, জয় মুজিবুর রহমান।’ আজ সেই মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর ১০০তম জন্মবার্ষিকী। দিনটি জাতীয় শিশু দিবসও। সেইসাথে মুজিব শতবর্ষের উদ্বোধন আজ। দিবসটি উপলক্ষে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন অকুতোভয় বীর, মহানায়ক। ছোটবেলা থেকেই তাঁর মধ্যে দেখা যায় নেতৃত্বগুণ; মানুষের প্রতি, দেশের প্রতি গভীরতর ভালোবাসা। পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসকরা তাঁকে বছরের পর বছর বন্দি রেখেছেন জেলে, নানা নির্যাতন-নিপীড়ন করেছেন। তার পরও তিনি ছিলেন স্বাধীনতার সংকল্পে অটল। দেশের মানুষের স্বার্থের জন্য, স্বাধীনতার জন্য তিনি ছিলেন আপসহীন। পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের মৃত্যুর পরোয়ানা উপেক্ষা করে তিনি তুলে ধরেছেন বাংলাদেশ ও বাঙালির কথা। বারবার আঘাত এসেছে তাঁর জীবনে; কিন্তু কখনো কোনো কিছুর বিনিময় বা প্রলোভনে বা ভয়ে বিন্দুমাত্র নতি স্বীকার করেননি, মাথা নিচু করেননি। ‘জয় বাংলা’ পঙক্তিকে হৃদয়ে ধারণ করে তাঁর নেতৃত্বেই মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি জাতি অর্জন করেছিল গৌরবোজ্জ্বল বিজয়।
বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ তদানীন্তন ভারত উপমহাদেশের বঙ্গ প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম শেখ লুৎফর রহমান এবং মায়ের নাম সায়েরা খাতুন। পরিবারের চার মেয়ে ও দুই ছেলের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন তৃতীয় সন্তান। সেদিনের টুঙ্গিপাড়ার অজপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করা সেই শিশুটি পরে হয়ে ওঠেন নির্যাতিত-নিপীড়িত বাঙালি জাতির মুক্তির দিশারি। গভীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, আত্মত্যাগ ও জনগণের প্রতি অসাধারণ মমত্ববোধ ও ভালোবাসার কারণেই অল্প বয়সেই হয়ে ওঠেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা।
কিশোর বয়সেই তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। গোপালগঞ্জের মিশন স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে তৎকালীন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগদানের কারণে শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমবারের মতো গ্রেপ্তার হয়ে কারাবরণ করেন। এর পর থেকে শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামীজীবনের অভিযাত্রা। বঙ্গবন্ধু তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে ১৯৪৮ সালে ছাত্রলীগ এবং পরে ১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগ গঠন করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগ ও স্বাধীনতা আন্দোলন, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬২ সালে শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালে ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান পেরিয়ে ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হন। রূপকথাকেও হার মানিয়েছেন ব্যক্তি মুজিব। দেশের জন্য নানা আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে, বাঙালি জাতিকে অপরিমেয় ভালোবাসার মধ্য দিয়ে তিনি পরিণত হন বঙ্গবন্ধু অভিধায়। আর বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের প্রতিটি অধ্যায়ে যেমন যুক্ত থেকেছেন, তেমনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ষাটের দশক থেকেই হয়ে উঠেছেন চিরভাস্বর। তাঁর জন্ম না হলে জন্ম হতো না বাংলাদেশের। তাই বাংলাদেশের অপর নাম শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ সেই কাঙ্খিত স্বাধীনতার ডাক দেন বঙ্গবন্ধু। তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে বিশাল জনসভায় ঘোষণা করেন বাঙালি জাতির কালজয়ী ইশতেহার। দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তাঁরই স্বাধীনতার ঘোষণায় ঐক্যবদ্ধ হয় জাতি, উত্তাল হয় গোটা দেশ। ২৫ মার্চ গভীর রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে তাঁর নামে স্বাধীনতার ঘোষণাটি প্রচার করা হয়। পরে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে, লাখো প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে ফিরে হাল ধরেন তিনি। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে শুরু করেন অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য নতুন সংগ্রাম। সোনার বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে তাঁরই নেতৃত্বে দেশ যখন এগিয়ে যাচ্ছিল তখন নেমে এসেছিল এক অমানিশার অন্ধকার। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কলঙ্কময় রাতে এক দল নরপশুর তপ্ত বুলেটে সপরিবারে শাহাদাত বরণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ওই সময় দেশের বাইরে থাকায় তাঁর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বেঁচে যান।
ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুকে ঘাতকরা হত্যা করলেও তাঁর আদর্শকে, তাঁর চেতনাকে, তাঁর কীর্তিকে হত্যা করতে পারবে না কেউ। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বাহক তাঁরই মেয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সেই সোনার বাংলাদেশ বাস্তবায়নের জন্য। পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়নে নিরন্তর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। তাঁরই প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ আজ বিশ্বের কাছে রোল মডেল।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.